স্বদেশ ডেস্ক: চোখ যে মনের কথা বলে পটোলচেরা সুন্দর চোখের প্রতি আকর্ষণ চিরকালীন। তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় আরও একধাপ এগিয়ে গাইলেন ‘ওগো কাজল নয়না হরিণী/তুমি দাও না ও দুটি আঁখি’। চিরকালীন আকৃতি চিরচঞ্চল বনের মায়াবী হরিণের প্রতি। ম্যানগ্রোভ সুন্দর বনের বড় পরিচয় এর বয়েল বেঙ্গল টাইগার। তবে পটোলচেরা মায়া হরিণও ধরে রেখেছে সুন্দর বনের আকর্ষণ। সেই থেকে হরিণের প্রতি মানুষের এক ধরনের টান অতীত থেকেই। এ জন্য হরিণও বড্ড প্রিয় মানুষের। কথায় কথায় উঠে আসে মায়া হরিণের নাম। তবে বনের রাজা ‘বাঘ মামার’ প্রিয় খাবার হরিণের মাংস। প্রকৃতি এ জন্যই বুঝিবা বাঘের চেয়ে হরিণের দ্রুতগতির লাফ একধাপ এগিয়ে রেখেছে। আগের দিনে বনেদি পরিবারের দেয়ালে হরিণের চামড়া, শিং ঝুলিয়ে রাখা হতো। শোনা যেত হরিণ শিকারের নানান কেচ্ছাকাহিনী।
বনের নীরবতায় আপন মনে ছুটে চলা দুরন্ত গতির এই মায়ামৃগ দেশে প্রধানত চার রকমের- বল্গা হরিণ, মায়া হরিণ, সম্বর হরিণ ও চিত্রা হরিণ। বনের চিরচঞ্চল মায়াবী হরিণ বেড়ে উঠছে বগুড়ার খামারে, বন্দী জীবনের ঘেরাটোপে। বগুড়া শহর থেকে প্রায় ২৫ কিমি উত্তর-পশ্চিমে শিবগঞ্জের পিরব ইউনিয়নের সিহালী গ্রামে। বনের মুক্ত বিহঙ্গের মতো ওরা এখানে স্বাধীন নয়। একটি চাতালের চারিধার ঘিরে রাখা সুপরিসর ঘরের মধ্যেই থাকতে হচ্ছে এদের। সামনে অনেকখানি জায়গাজুড়ে ঘিরে দেয়া উন্মুক্ত বাগান এসব হরিণের বসবাস। হরিণের পালনকর্তা শৌখিন ব্যবসায়ী মখলেসুর রহমান (৬৮)। জানালেন, সরকারের অনুমতি, সংশ্লিষ্ট সকল বিভাগের সনদপত্র নিয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিনি গড়ে তুলেছেন এই হরিণের খামার। বলা চলে সুপরিসর বাগান। বলেন ছোটবেলা থেকেই হরিণ পালনের শখ ছিল তার। যখন চিড়িয়াখানায় যেতেন চিরচঞ্চল হরিণের ছুটোছুটি দেখে তার মন ভরে যেত। এক সময় সিদ্ধান্ত নেন নিজেই হরিণের বাগান গড়ে তুলবেন, হরিণ প্রতিপালন করবেন। মোখলেসুর রহমানের খামারে গিয়ে হরিণগুলোর লাফালাফি ছুটোছুটি দেখে মনে হলো এখানে ওরা ফুর্তিতেই আছে। স্থানীয় লোকজন জানান, প্রথম যখন আনা হলো সারাক্ষণ মুখ গোমড়া করে থাকত, ওদের ভাষায় কথা বলত। যখন বুঝতে পারে এখানে ওরা বন্দী তখন আস্তে আস্তে সুপরিসর ঘর আর বাগানকেই বন মনে করে এখন মানিয়ে নিয়েছে। খাবার দেয়ার সময় হলে ওরা ছুটে আসে। বনের নিরীহ এই প্রাণীগুলোর নিরিবিলি পছন্দ। নিজে থেকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে। এজন্যই বুঝি ওদের রোগবালাই কম। যেখানে সেখানে মলমূত্র ত্যাগ করে না। এমনকি পরিষ্কার না হলে খাবারও খায় না। তিনি জানান, ২০০৩ সালে বন বিভাগের বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ থেকে হরিণ পালনের সনদপত্র নিই। এরপর রাজশাহী চিড়িয়াখানা থেকে প্রায় চল্লিশ হাজার টাকায় দু’বছরের চিত্রা প্রজাতির একটি পুরুষ ও একটি স্ত্রী হরিণ কিনে আনি। শখের এই দুই হরিণ বড় হলে ছোট্ট পরিসরে বাগান গড়েন। দুই চিত্রা হরিণের বাচ্চা হয়। দেড় বছর পর থেকে একটি করে বাচ্চা প্রসব করে। বন বিভাগের অনুমতিতে গত ১৫ বছরে কয়েকটি জেলায় গড়ে ওঠা বিনোদন পার্ক, পিকনিক স্পট, সামাজিক বনে তিনি হরিণ বিক্রি করেছেন। যারা কেনেন তাদেরও লাইসেন্স বা সনদপত্র থাকতে হয়। প্রথম দিকে প্রতিটি ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করেন। তবে জোড়া কিনতে হয়। না হলে হরিণ থাকে না। বর্তমানে প্রতি জোড়া ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকা বিক্রি করছেন। বর্তমানে তার খামারে আছে বারোটি হরিণ। কয়েকটি হরিণের বাচ্চা হওয়ার সময় এসেছে।
হরিণ দেখভালের কর্মীরা জানান, জন্মোর পর বাচ্চার গায়ে হাত দিলে হরিণ আর ওই বাচ্চাকে সহজে দুধ দেয় না। হরিণ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে পছন্দ করে। খামার পরিষ্কার রাখা হয় সবসময়। নারী ও পুরুষ হরিণের মধ্যে খুব ভাব। ভাবের আগে ডাকাডাকি আর লাফালাফিই ওদের প্রেমের আমন্ত্রণ। এই খামারের সকল হরিণ চিত্রা। সিহালী এলাকার মাসুদ রানা জানান, বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন হরিণ দেখতে আসে। হরিণ পালনে সরকারী লাইসেন্স করতে হয়, খরচও অনেক। সে কারণে ইচ্ছে থাকলেও সহজে কেউ হরিণ পালন করতে পারে না। মোখলেছুর রহমান জানান, হরিণ প্রধানত পত্রভোজী। কচি পাতা, কাঁঠাল পাতা, নরম ঘাস, অঙ্কুরিত চারা শৈবাল, নরম ফল খেতে দিতে হয়। আঁশযুক্ত খাবার এরা খায় না। এদের পাকস্থলী ছোট। রেইন হরিণ ছাড়া সকল পুরুষ হরিণের শিং আছে। হরিণ নিজে থেকেই পরিষ্কার থাকে, ওদের রোগবালাই কম। যেখানে সেখানে মলমূত্র ত্যাগ করে না। পরিষ্কার না হলে খাবারও খায় না। তিনি আরও জানান, হরিণ প্রতিপালনে নিয়ম আরও সহজ করা দরকার। ফি, লাইসেন্স ও নবায়ন ফি কমালে দেশে অনেক হরিণ খামার গড়ে উঠবে। যুবকরাও হরিণ পালনে আগ্রহী হয়ে উঠবে। সরকারী সহযোগিতা পেলে তিনি আগামীতে হরিণের পাশাপাশি উট ও দুম্বার খামার গড়ে তুলতে চান। দেশে হরিণ, দুম্বা ও উটের খামার গড়তে বেসরকারী উদ্যোগকে সহজ করলে কাজের পরিধি সৃষ্টি হয়ে অর্থনৈতিক অগ্রগতি হবে।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা জানান, চিত্রা হরিণের খামারে সহযোগিতা করা হয়। যারা হরিণ পালন করছেন তাদের এই ভালবাসায় খাদ আছে কিনা তাও একটা প্রশ্ন। কারণ তারা হরিণের খামার বা বাগান বানিয়ে পালন করে বেশি দামে বিক্রি করে দেন।